বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ , ১৩ চৈত্র ১৪৩০

modhura
Aporup Bangla

আগুন নিভে গেলেই কর্তব্য ফুরিয়ে যায় না

মতামত

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

প্রকাশিত: ১২:২২, ৪ মার্চ ২০২৪

আপডেট: ১২:৩৮, ৪ মার্চ ২০২৪

সর্বশেষ

আগুন নিভে গেলেই কর্তব্য ফুরিয়ে যায় না

ছবি সংগ্রহ

আগুনের শিখা নিভে গেলে দগ্ধাবশেষের পার্শ্বেই পড়ে থাকে এক নির্মম সত্য— এই আগুনই শেষ নয়। বেইলি রোডের আগুনও শেষ নয় যদিও কত কিছু যে বলবেন এখন আমাদের নিয়ন্ত্রক আর নীতি নির্ধারকরা। এ লেখা শুক্রবার দুপুরে যখন লিখছি তখন টেলিভিশনের স্ক্রলে ভেসে আসছিল পরিসংখ্যান– ঢাকার বেইলি রোডে বহুতল রেস্তোরাঁ ভবনে অগ্নিকাণ্ডে নিহতের সংখ্যা ৪৬ জনে পৌঁছেছে। গুরুতর আহত রয়েছেন অন্তত ২২ জন। এ ঘটনায় নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

দিনটি ছিল ২৯ ফেব্রুয়ারি। প্রতি চার বছর পর এমন দিন আসে। কিন্তু কেন যে এসেছিল এমন একটা দিন এখন সেটাই মানুষের কাছে প্রশ্ন। ভবনের দ্বিতীয় তলায় ‘কাচ্চি ভাই’ নামের খাবারের দোকান রয়েছে যারা এই লিপ ইয়ার উদযাপনের জন্য বড় ছাড় দিয়েছিল বিরিয়ানির দামে। পুরো ভবনে খাবারের দোকান, সবগুলোর রান্নাঘর চলে সিলিন্ডার গ্যাসে। তলায় তলায় স্তুপ করা গ্যাসের সিলিন্ডার। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকে খাবারের দোকানগুলোতে ক্রেতাদের ভিড় হয়। অনেকেই পরিবার নিয়ে সেখানে খেতে যান। ২৯ ফেব্রুয়ারি বিধায় ভিড় আরও বেড়ে গিয়েছিল।

কেমন ছিল এই ভবনটির অবস্থা সেটা জানা গেল আগুনের এত্তগুলো প্রাণ চলে যাবার পর। প্রতিটিতে সিঁড়িতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল গ্যাস সিলিন্ডার। আগুনে সেগুলো বিস্ফোরিত হয়েছে একের পর এক। ভবনে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র এবং ভ্যান্টিলেটরের কোনো ব্যবস্থাই ছিল না।

একই দিনে জাতীয় বীমা দিবস ছিল। সেখানকার এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেইলি রোডে আগুন লাগা ভবনে অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, ‘অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা বাড়ানোর নির্দেশ দিচ্ছি, সেটা কিন্তু আর মানে না”। এখন ফায়ার সার্ভিস, রাজউক, সিটি কর্পোরেশন কর্তারাও নানা কথা বলবেন।
একটি করে ঘটনা ঘটে আর আমরা এসব কথা শুনি। তবে আমরা ভাল করেই জানি কয়েকটি দিন কিছু কথা হবে, কিছু উদ্যোগের কথা বলা হবে তারপর আরেকটি ঘটনা এসে বেইলি রোডের বেদনাকে বহুদূর নিয়ে যাবে। কেউ মনেও রাখবে না কি ঘটেছিল বেইলি রোডে। এই শহরের ভবিষ্যতে আরও অনেক আগুন, আরও অনেক প্রাণ ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি লুকিয়ে আছে।

একটি বহুতল ভবন পুরোটাই খাবারের দোকান, প্রতি তলায় রান্নাঘর, সিঁড়ি আর রান্নাঘরে গ্যাস সিলিন্ডার– এক নতুন খাদ্য সংস্কৃতি এই শহরে। ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোড ও ২৭ নম্বরে, উত্তরায়, বনানীতে, গুলশানে, পুরোনো ঢাকায় এমন অসংখ্য ভবন পাওয়া যাবে। প্রতিটিই ঝুঁকিপূর্ণ, কিন্তু সবগুলোই চলছে কর্তৃপক্ষের চোখের সামনে।

স্থপতি মুস্তাফা খালিদ পলাশ তার ফেসবুক পেজে এরকম একটি ভবনের ছবি দিয়ে লিখেছেন, “প্রতিনিয়ত এই ভবনটি নিয়ে সত্যি উৎকণ্ঠায় থাকি। নক্সা এবং অনুমোদন বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে হলেও এর ব্যবহারে বড় রকমের ব্যত্যয় ঘটিয়ে সার্বিক ভাবে একে সমূহ অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ রেস্তোরাঁ ভবনে রুপান্তর করা হয়েছে। স্থপতি হিসেবে শেষ যে ক্ষমতাটুকু রাজউক দিয়েছে অকুপেন্সি সার্টিফিকেটের জন্য রিপোর্ট স্বাক্ষর করার তার তোয়াক্কাও এখানে করা হয়নি। অকুপেন্সি সার্টিফিকেট না নিয়েই চলছে দেদার ব্যবসা। যেহেতু ভবনটি নির্দিষ্ট ব্যবহারের ব্যত্যয় করে ব্যবহার শুরু করে দেয়া হয়েছে তাই স্থপতি হিসেবে রিপোর্ট ও এজবিল্ট ড্রইং প্রদান থেকে বিরত থেকে জমির মালিক, ডেভেলপারকে বারংবার লিখিত বার্তায় এ বিষয়ে সতর্ক করা হলেও কোনো ফলপ্রসু অগ্রগতি হয়নি। অর্থগৃধ্নুতার কাছে আমার আহাজারি বারবারই নিস্ফল হচ্ছে। ডেভেলপারকে জিজ্ঞেস করলে উত্তর আসে তাদের নাকি ফায়ার লাইসেন্স আছে। কি করে সম্ভব সেটা? কপি চাইলে নিরুত্তর। জমির মালিককে বললে উত্তর, ভাড়া হয় না তাই আর কি করা!


যতদূর জানি এ ভবনের অগ্নীনিরাপত্তার অবস্থা ক্রমান্বয়ে ভয়াবহভাবে অবনমিত করা হয়েছে। ফায়ার ডোর খুলে ফেলা হয়েছে, ফায়ার স্টেয়ার স্টোররুম হয়েছে, যত্রতত্র গ্যাস সিলিন্ডার রাখা হয়েছে ইত্যাদি”।

শুধু এসব ভবনই না। ঢাকার প্রায় সব ভবনের একই অবস্থা, অগ্নিবিধি মেনে কিছু করা হয়না। এই শহর আক্ষরিক অর্থেই আগুন নিয়ে খেলে। যে বহুতল ভবনগুলো আগুনের গ্রাসে পড়েছে, আর যেগুলি এখনও আগুন নিয়ে খেলছে তাদের সব গুলোতেই বহু মানুষের বাস, বহু ব্যবসার ঠিকানা। আইন আর বিধিকে ফাঁকি দিয়ে ওরা ব্যবসা করে যার ফাঁক গলে আগুনের শিখা অগ্রসর হয়। তারপর, একদিন দাউদাউ জ্বলে উঠে। তখন সংবাদ হয়, কর্তারা নড়ে চড়ে বসেন, দমকল, সিটি কর্পোরেশন অজুহাত খাড়া করে। দিন কতক কাটলে, অবস্থা পূর্ববৎ।

আইন, বিধি, আগুন নিরাপত্তার অজস্র কথায় যে বিষয়টি হারিয়ে যায়, আমরা কেউ বলি না বা বলতে চাই না তাহলো, প্রতিটি আগুনের ঘটনা সুশাসনের ব্যর্থতার নজির ও ক্ষমতা কাঠামোকে নিয়ন্ত্রণ করা রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাধারণ মানুষের জীবনকে উপেক্ষা করার ভয়াবহ প্রবণতা। কোনও বাড়িতে বা বাণিজ্যিক কেন্দ্রে অগ্নিবিধি মানা হচ্ছে কিনা, তা দেখা যাদের দায়িত্ব তারা সেটা না করলেও কোন জবাবদিহি করতে হচ্ছে না। কারণ হলো রাজনীতি। এরা ক্ষমতা কেন্দ্রের বাসিন্দা। বনানি এফ আর টাওয়ারের আগুনের পর পূর্ত বিভাগ ও রাজউকের বিষয়ে কিছু ব্যবস্থা নিতে গিয়ে এক মন্ত্রীর মন্ত্রণালয়ই বদলে গিয়েছিল।


আর কতকাল দায়িত্বজ্ঞানহীনতা? অন্তত এবার প্রশাসন বলুক, আগুন নির্বাপিত হলেই কর্তব্য ফুরিয়ে যায় না। আগুন কেন লাগে? তার প্রথম কারণ, এই শহরে অগ্নি-নিরাপত্তা বিধি বলে কিছুর কার্যত অস্তিত্ব নেই। কিছু আদিম প্রস্তর যুগের নিয়ম রয়েছে, যার কোনও বাস্তবতা নাই। আন্তর্জাতিক মানের সাথে তার আলোকবর্ষের দূরত্ব। রাজধানীর,দেশের অন্য শহরের সব বহুতলের জন্য অগ্নি-নিরাপত্তা নতুন অগ্নিবিধি কড়াভাবে প্রণয়ন ও প্রয়োগ করতে হবে। দায় সারবার জন্য নয়, সুরক্ষা নিশ্চিত করবার জন্য। উন্নত দেশগুলি কী করছে, তা বুঝতে হবে, সেই প্রক্রিয়ার সাথে সঙ্গতি রাখতে হবে।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।

সর্বশেষ