শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪ , ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

modhura
Aporup Bangla

অপরূপ বাংলার মুখোমুখি অধ্যাপক যতীন সরকার

জেল থেকেই আমি লেখক হয়েছি

শিল্প-সাহিত্য

প্রকাশিত: ১৯:১১, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

আপডেট: ১৯:১৭, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

সর্বশেষ

জেল থেকেই আমি লেখক হয়েছি

অধ্যাপক যতীন সরকার

অধ্যাপক যতীন সরকার বর্তমান বাংলা সাহিত্যের বটবৃক্ষ। লেখালেখির ক্ষেত্রে তিনি প্রাকৃতজন ও প্রগতিশীল ধারার লেখক। প্রবন্ধ সাহিত্যে তার প্রজ্ঞা অকল্পনীয়। ৫০ বছর বয়সে মুক্তধারা থেকে  প্রকাশতি হয় তাঁর প্রথম গ্রন্থ। বইটি নিয়ে দুই বাংলায় হৈচৈ পড়ে যায়। তারপর দীর্ঘ ৩০ বছর যাবৎ লেখালেখি করে যাচ্ছেন তিনি। প্রবন্ধসহ নানা আঙ্গিকের বহু মূল্যবান গ্রন্থ  রচনা করেছেন তিনি। মার্কসবাদী দর্শন ও পাবলভীয় মনোবিজ্ঞান তার লেখালেখির মূল শক্তি। স্বাধীনতা পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর পক্ষাবলম্বন করায় জেল খাটতে হয়েছে তাঁকে। তাইতো তিনি হাসতে হাসতে বললেন, জেল থেকেই আমি লেখক হয়েছি। 
অধ্যাপক যতীন সরকার বাংলা একাডেমি পুরস্কার, স্বাধীনতা পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।  
নেত্রকোনা শহরের সাতপাই  এলাকায়  ‘বানপ্রস্ত’- নিজের বাড়িতে অবসর জীবনযাপন করছেন তিনি। এই মহান সাহিত্যিকের গৃহে উপস্থিত হয়ে সাক্ষাকার গ্রহণ করেছেন বাংলা একাডেমির গবেষণা কর্মকর্তা আইযুব মুহাম্মদ খান এবং অপরূপ বাংলা পত্রিকার সম্পাদক টুটুল রহমান। দীর্ঘ সময় ক্লান্তিহীন আলাপচারিতা চলে। সেখানে প্রাণখোলা শিশু সুলভ এই মানুষটি তাঁর লেখালেখির জীবন,  জীবন দর্শন, রাজনৈতিক বিশ্বাস, ধর্ম, শিল্প- সাহিত্যের নানা দিক নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন।  
  অধ্যাপক যতীন সরকারের মহামূল্যবান সাক্ষাৎকারটি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-

অপরূপ বাংলা : নমস্কার স্যার। কেমন আছেন স্যার?

অধ্যাপক যতীন সরকার : নমস্কার, জীবিত আছি তবে বেঁচে নেই।

অপরূপ বাংলা : এ কথা কেন বলছেন, স্যার?

অধ্যাপক যতীন সরকার : গাড়ের হার ক্ষয় হয়েছে। পড়তে পারি না। লিখতেও পারি না। এজন্য এটাকে বেঁচে থাকা বলে না। ভারাক্রান্ত মুখ! কিঞ্চিৎ সময় পর  মিষ্টি হাসি দিয়ে বলেন- আমি তো রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বড়। রবীন্দ্রনাথ আশি বছর বেঁচেছিলেন। আমি তাঁর চেয়ে বেশি...হা হা হা...হাঁসতে হাঁসতে বলেন- 
আসলে আমি কিন্তু নিজেকে লেখক ভাবি না। 
অপরূপ বাংলা  : এমন কথা কেন বলেন স্যার? বাংলা সাহিত্যে আপনার লেখা অমূল্য সম্পদ। আপনি না লিখলে বাংলা সাহিত্যের চরম ক্ষতি হবে।

অধ্যাপক যতীন সরকার : বাংলা সাহিত্য এতো দীন দরিদ্র না যে যতীন সরকার না লিখলে বাংলা সাহিত্যের ক্ষতি হবে। আমাকে অনেকেই লিখতে বলছে আমি কিন্তু লিখি নাই। তবে ১৯৬৭ সালে পাকিস্তানোত্তর পূর্বপাকিস্তানের বাংলা উপন্যাসের ধারা-এই বিষয়টা নিয়ে একটা গবেষণা প্রবন্ধ চাওয়া হয়েছিল বাংলা একাডেমি থেকে। ড. এনামুল হক স্বর্ণ পদক দেয়ার জন্য। আমার ছোট ভাই মতীন্দ্র তখন জগন্নাথ হলে থাকে, সে বলতে গেলে জোর করে আমাকে এই প্রবন্ধটা লেখালো এবং আমি ড. এনামুল হক স্বর্ণ পদক পেয়ে গেলাম। পরে এটি বই হিসেবে বের হয়। এই বইয়ে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের উপন্যাসের ধারা তুলে ধরা হয়েছে।  বাংলাদেশ হওয়ার পর উপন্যাসসহ সাহিত্যের অন্যান্য শাখার ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আমি মনে করি  আমাদের বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্যে এমন অনেক কিছু লেখা হয়েছে যেগুলো সত্যিকার অর্থে যদি অনুবাদ হতো তাহলে বিশ^ সাহিত্যের মধ্যে স্থান পেতো। কিন্তু  এর অনুবাদ প্রায় নাই বললেই চলে। এই ভালো ভালো বইগুলোর অনুবাদ করা দরকার  বলে আমি মনে করি। আমি বাংলা উপন্যাসের দুই দশক নিয়ে লিখেছিলাম। পরবর্তীকালে অনেক উপন্যাসিক, প্রবন্ধকার বেরিয়ে এসেছেন। যেমন উপন্যাসিক হূমায়ূন আহমেদ। তিনি কত বড় উপন্যাসিক সে বিষয় বিচার না করে এটুকু বলা যেতে পারে, হূমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশে প্রচুর পাঠক সৃষ্টি করেছেন। যারা অন্য কোনো বই পড়ে না, বই পড়ার প্রতি আগ্রহ নেই, তারাও হূমায়ূন আহমেদের  বই পড়েছে এবং এখনও পড়ছে। তিনি অনেক লেখা লিখেছেন। হূমায়ূন আহমেদকে নিয়ে প্রথম লেখাটি আমার। নন্দিত নরকে ও শঙ্খনীল কারাগার এই দুটি উপন্যাস নিয়ে আমি লিখেছিলাম। 
অপরূপ বাংলা : থামলেন কেন, স্যার? বলুন, খুব ভালো লাগছে।
অধ্যাপক যতীন সরকার : হ্যাঁ বলছি, বয়স হয়েছে তো! 
অপরূপ বাংলা : হ্যাঁ, স্যার।
অধ্যাপক যতীন সরকার  : তো তিনি ভূমিকায় বলেছিলেন, সৌমেন চন্দের ইঁদুর গল্প পড়ে তিনি লেখায় উদ্¦ুদ্ধ হয়েছিলেন। আমি আমার প্রবন্ধে বলেছিলাম সৌমেন চন্দের উত্তর সাধক চাই এবং হূমায়ূন আহমেদ এটা হতে পারেন। তিনি এটা হবেন কিনা অথবা অন্য কোনো লাইনে যাবেন কিনা, এটা আমি জানি না। তবে শঙ্খনীল কারাগার ও নন্দিত নরকে বই দুটো আমাদের আশা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। তিনি পরবর্তীতে অনেক লেখা লিখলেন। হূমায়ূন আহমেদ  বাংলাদেশের সবচেয়ে পাঠক প্রিয় লেখক।

অপরূপ বাংলা : জি, স্যার।

অধ্যাপক যতীন সরকার : ইমদাদুল হক মিলনও যথেষ্ট পাঠক প্রিয়। তবে আমি সবচেয়ে মূল্য দেই সত্যেন সেনকে।  আমার সঙ্গে তাঁর খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। আমি তাঁর সম্পর্কে আগাগোড়া জানি। আমি তো কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। সেই সুবাদে আমি ময়মনসিংহে থেকেছি। ময়মনসিংহের বাসায় সত্যেন দা আসতেন। সত্যেন দা হাস্যরসের মাধ্যমে বলতেন, আমার সবচেয়ে বেশি উপকার করেছে সেই লোকটি যে লোকটি দেশের সব মানুষের ক্ষতি করেছে। 
অপরূপ বাংলা : হা  হা  হা... এটা কেমন কথা স্যার!
অধ্যাপক যতীন সরকার : হ্যাঁ বলছি, শুনুন। তিনি বলেন, সে হচ্ছে আইয়ূব খান। আইয়ূব খান আমাকে জেলে রাখলো এবং জেলে পাঁচ-ছ বছর থেকে আমি লেখক হয়েছি। জেলে না গেলে আমি লেখক হতাম না। জেল থেকেই আমি লেখক হয়ে বেরিয়ে এসেছি। আসলেই সত্যেন সেনের উপন্যাসগুলি অসাধারণ!  তার ঐতিহাসিক উপন্যাসের তুলনা হয় না। ঐতিহাসিক উপন্যাস সত্যেন সেনের মতো ভালো আর কেউ লিখতে পারেন নাই। এ কারণে তিনি আমাদের গর্ব। আমাদের সাহিত্যের গর্ব।  
অপরূপ বাংলা : সত্যি বলেছেন, স্যার।
অধ্যাপক যতীন সরকার : আপনারা সত্যেন সেন পড়েন। সত্যেন সেন পড়বেন। 
অপরূপ বাংলা : হ্যাঁ, স্যার। সত্যেন সেনের ‘ভোরের বিহঙ্গী’, ‘দেয়ালের দেশ’ কত দামি উপন্যাস! 
অধ্যাপক যতীন সরকার : ঠিক বলেছেন। এখন কবি শামসুর রাহমানের কথা বলি। তাঁকে তো সবাই জানে। বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি বলা হয়। তারপরে কবি আল মাহমুদ। আল মাহমুদের রাজনৈতিক চিন্তা ধারার সাথে আমাদের অনেক অমিল আছে কিন্তু স্বীকার করতেই হবে কবি হিসেবে তাঁর অনেক ভালো ভূমিকা রয়েছে। কবি হিসেবে আল মাহমুদ যথেষ্ট ভালো। শামসুর রাহমানের পরেই যদি তাঁকে স্থান দেওয়া হয় তাহলে এটা ভুল হবে বলে আমি মনে করি না। উপন্যাসে হূমায়ূন আহমেদের পরে এলেন সেলিনা হোসেন। তাঁর উপন্যাসগুলো আসলেই অনেক উচ্চমান সম্পন্ন। হূমায়ূন আহমেদ জনপ্রিয় কিন্তু সেলিনা হোসেন উপন্যাসে সত্যেন সেনের পরেই স্থান পাবে বলে আমি মনে করি। আমরা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কথাও বলতে পারি। তিনি তো কম লিখেছেন। আমি তাঁর কথাটা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। তিনি যত কমই লিখুন না কেন অল্প লিখেও বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কথা বলতে গেলে, তাঁর যে উপন্যাস ‘লালসালু’ এই উপন্যাস দিয়েই তখনকার দিনে পূর্বপাকিস্তানের বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করি। তারপর অনেক লিখেছেন। তাঁর কাছে আমরা সাহিত্যের পাঠক হিসেবে ঋণী। 
 

অধ্যাপক যতীন সরকার : আমার প্রথম বই সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা। সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে কি না জানতে চাইলে আমি বলবো, এক কথায় আমি যা প্রত্যাশা করেছিলাম বাংলা সাহিত্য সেই পথেই অগ্রসর হচ্ছে বলে আমি মনে করি। আমি  ড. মুহম্মদ এনামুল হক স্বর্ণপদক পাওয়ার পর জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সরদার জয়েনউদ্দিন আমাকে জোর করতে লাগলেন, বাংলায় মুসলমানের উপন্যাস নিয়ে আপনাকে লিখতে হবে। এ কথায় আমি প্রবৃত্ত হলাম। আমি বাংলা উপন্যাসে মুসলমানের অবদান নিয়ে একটি পা-ুলিপি তৈরি করেছিলাম। প্রায় তিন-চতুর্থাংশ লেখা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় যখন সব লুটপাট হয়ে যায়, আমরা তখন ময়মনসিংহে ছিলাম। সব কিছুর সঙ্গে আমার এই পা-ুলিপিও লুটপাট হয়ে গিয়েছিল। কাজেই আমি আর ওই বিষয়ে অগ্রসর হতে পারলাম না। স্বাধীনতার  সময়ে আমি ভাটি এলাকায় ছিলাম। ভাটি এলাকায় থাকা অবস্থাতে আমার এখানে নাসিরাবাদ কলেজের অনেক ছাত্র আসতো। ওই সময়ে আমার এক ছাত্র পরে অধ্যাপক হয়েছিল। নুরুল হকের বাসায় আমি থাকতাম। পালিয়ে থাকতাম বলা চলে। ওই সময়ে যারা আসতো  আমার কাছে তাদের আমি মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য সম্পর্কে বলতাম এবং এখান থেকে অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেছে। ওখানে আমি পাঠচক্রের মতো করেছিলাম। এটার কারণে ওই অঞ্চল থেকে অনেক ছেলে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছে। কিন্তু ওই সময়ে দেখা গেছে আওয়ামী  লীগের মধ্যে কিছু লোক রক্ষনশীল ছিলেন। কেউ ছাত্র ইউনিয়ন করেছে, কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত আছে জানা থাকলে তারা মুক্তিযুদ্ধে নিতেন না।  এ কারণে দেখা গেলো মেঘালয়ে কমিউনিস্টরা সে সময়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখান থেকে  যতীশ বোস, অজয় রায়, কাজী আবদুল বারী তাদের নেতৃত্বেই যারা সেই সময়ে ছাত্র ইউনিয়নসহ বাম ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাদের নিয়ে একটি সংগঠন করা হলো। 
অপরূপ বাংলা : বলেন, স্যার। 

অধ্যাপক যতীন সরকার : হ্যাঁ বলব। তারা কিন্তু ভালো কাজ করেছিল। তাদের অনেক সংগ্রাম, আত্মত্যাগ করতে হয়েছে। অনেকে শহীদ হয়েছেন। ভারত সরকার তাদের আলাদা করে স্থান দিয়েছিল। এখানে কিন্তু অনেক লেখক ছিলেন। সেই লেখকদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ হয় নাই। তবে তারা লেখা শুরু করেছিলেন। তাঁদের অনেকেই নিহত হয়েছিলেন। আমি মনে করি, তাঁরা যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে তাঁদের হাত দিয়ে বাংলা সাহিত্যের নতুন ধারার সৃষ্টি হতো। কথাগুলো কেমন লাগছে? 
অপরূপ বাংলা : অবশ্যই ভালো লাগছে স্যার।

অধ্যাপক যতীন সরকার : ময়মনসিংহে আমার জীবনের অনেক সময় কেটেছে। ৪২ বছর আমি সেখানে ছিলাম। আমি তখন নাসিরাবাদ কলেজে মাস্টারি করি। সেই সময়ে কবীর চৌধুরী আনন্দ মোহন কলেজে এলেন অধ্যক্ষ হয়ে। কবীর চৌধুরীর সঙ্গে আমার অনেক ভালো সম্পর্ক হয়ে গেলো। তিনি আমাকে লিখতে উদ্বুদ্ধ করলেন। তিনি বললেন কি কি বিষয়ে লিখতে হবে। তার কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে আমি লেখক হয়েছি। সত্যেন সেন অনেক বড় মানুষ ছিলেন। তার মতো বলতে পারি না। কিন্তু এই কথাটি বলতেই হবে তিনি যেমন জেলখানায় গিয়ে লেখক হয়েছেন আমিও তেমনি জেলখানায় গিয়ে লেখক হয়েছি। ১৯৭৬ সনের মার্চ মাসের প্রথম দুই/এক তারিখের মধ্যেই আমাকে ধরে নিয়ে যায়। ঠিক  আঠারো মাস আমি ময়মনসিংহ জেলখানায় ছিলাম।  আমার সঙ্গে ৫০ জনের মতো রাজবন্দি ছিলেন। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পরে যাঁরা তার পক্ষপাতিত্ব করতেন, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন তাদের নিয়ে জেল ভরে ফেলেছিল। আমরা এক জায়গায় ৫০ জন ছিলাম। তোফায়েল আহমদ ছিলেন আমাদের সঙ্গে। আমাদের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন আবদুল হামিদ তিনিও  ছিলেন।  হামিদ সাহেব আর আমি পাশাপাশি বেডে থাকতাম। ওই সময় ওইখানে জেলখানায় পাঠচক্রের মতো গড়ে উঠলো। সেখানে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা হতো। আমি কথা বলতাম। আমি তো মাস্টার। আমি মাস্টার হতে চেয়েছি। মাস্টার হয়েছি। আমার জীবনে আর কোনো অপ্রাপ্তি নেই। সেখানে আমি যে কথাগুলো বলতাম সেগুলো শুনে তোফায়েল আহমদসহ অনেকেই বলতেন ‘আপনি এই যে কথাগুলো বলেন, এগুলো আপানি লিখেন না কেন?’ আমি বলি লিখে কি হবে?

অপরূপ বাংলা : তারপর বলেন, স্যার।
অধ্যাপক যতীন সরকার : বলব, অবশ্যই বলব। তখন তারা বলতেন ‘ না না না। এগুলো লিখতে হবে। তখন ওই জেলখানায় ফরহাদ নামে একজন ডেপুটি জেলার নিযুক্ত হয়ে গেলেন। ফরহাদ সাহেব যেদিন যোগদান করলেন সেই দিনই আমার সঙ্গে দেখা করলেন। তার সাথে আগে কোনো পরিচয় ছিল না  কিন্তু বললেন, আপনাকে আমি চিনি আপনার যা প্রয়োজন বোধ করবেন আমাকে বলবেন।  আমি সব ব্যবস্থা করবো। তারপর আমি সবার কথায় উদ্বুদ্ধ হলাম। ফরহাদ সাহেবের মাধ্যমে খাতা সংগ্রহ করে লিখতে শুরু করলাম। ফরহাদ সাহেব একদিন বললেন ‘এই যে আপনি খাতার মধ্যে লিখছেন এগুলো কিন্তু বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবেন না।’  আমি বললাম ‘কেন?’ 
কর্তৃপক্ষ এগুলো নিয়ে যাবে। তারপর ফেরত দেয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। আমি বল্লাম, ‘সব্বোনাশ তাহলে কি করতে হবে।’  উনি বললেন, ‘আপনি আমার কাছে দেন।’

অপরূপ বাংলা : স্যার, বলেন।
অধ্যাপক যতীন সরকার : এরপর আমি একটা  করে খাতা লিখতাম আর ফরহাদ সাহেব আমার বাড়িতে আমার স্ত্রীর কাছে পৌঁছে দিতেন। ফরহাদ সাহেব প্রাকটিক্যালি লেখাগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে দিলেন। এই ফরহাদ সাহেবের কল্যাণে আমি জেলখানা থেকে লেখা লিখতে পেরেছি। ফরহাদ সাহেব সম্ভবত চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহীর মানুষ ছিলেন। আমি তো রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। রাজশাহীর লোক আসলেই আমার সঙ্গে খুব ভালো একটা সম্পর্ক গড়ে উঠতো। 

অপরূপ বাংলা : ফরহাদ সাহেবের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ আছে?
অধ্যাপক যতীন সরকার : জেলখানা থেকে আসার পর উনার সঙ্গে অনেক দিন যোগাযোগ ছিল। সম্ভবত এখনো উনি বেঁচে আছেন। অনেক দিন যাবৎ যোগাযোগ নেই। আমার লেখালেখিতে তাঁর বিরাট ভূমিকা রয়েছে। এরপর জেলখানা থেকে বের হলাম। আমার বন্ধুরা এগুলো প্রকাশের জন্য ধরলেন। শাসমুজ্জামান খান বিশেষ করে আমাকে ধরলেন।  বাংলা একাডেমির পরিচালক, পরে মহাপরিচালক হয়েছেন। তিনি প্রয়াত। তাকে লেখাগুলি দিলাম তিনি সেগুলি নিয়ে  ‘মুক্তধারা’তে দিলেন চিত্তরঞ্জন সাহার কাছে।  আমার বইয়ের নাম দিলাম ‘সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা’। তখন আমার ৫০ বছর বয়স। এই বয়সে আমার প্রথম বই বের হয়। এই বই বের হওয়ার পর বিভিন্ন  জায়গা থেকে নানান জনের কাছ থেকে প্রশংসা এসেছে। পশ্চিমবঙ্গের পত্রিকার মধ্যে লিখেছে, সাহিত্যের সমালোচনা যে  এতো ঋদ্ধ হতে পারে  রবীন্দ্রনাথ ও প্রমথ চৌধুরীর পরে আমরা এমন দেখি নাই। যদিও কথাটা অনেক বাড়াবাড়ি হয়েছে মনে হয়। তবে আমি এটা লিখেছি মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে। ঐতিহাসিক বস্তুবাদকে আমি বলি আমার জীবন দর্শন। সেই জীবন দর্শনের  উপর ভিত্তি করেই আমার লেখালেখি কথাবার্তা, কাজ-কর্ম সব কিছু। একটু পরে বলছি। 

অপরূপ বাংলা : ঠিক আছে, স্যার। দশ মিনিট পরে বলেন।
অধ্যাপক যতীন সরকার : দশ মিনিট হয়েছে, এখন বলি। আমার লেখাগুলো কেবল মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে লিখেছি বললে অবশ্য সঠিক বলা হয় না।  কারণ হলো, মার্কসবাদীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করেন না। সেইদিক দিয়ে আমি একজন বিশিষ্ট মানুষকে পেয়েছি। শামসুজ্জামান খান অনেক অনুষ্ঠানে আমাকে নিয়ে গেছেন। আমি কিন্তু আসলে ‘গাঁইয়া’।  গ্রামের মানুষ। শামসুজ্জামান খান ময়মনসিংহ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। সেই সময় থেকে তাঁর সাথে  আমার পরিচয় এবং আমার বন্ধু হয়ে গেলেন। তখন তিনি সহকারী অধ্যাপক ছিলেন। এ রকম পরিণত বয়েসে তাঁর মতো মানুষের কেউ বন্ধু হতে পারে আমার জানা নেই। তিনি আমার অনেক উপকার করেছেঁন। শামসুজ্জামান খান বাংলা একাডেমিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমাকে নিয়ে গেছেন। সেখানে আমি কথাবার্তা বলেছি। নিভৃত পল্লী থেকে আমাকে তিনি তুলে এনেছেন। আমি পড়াশুনা করেছি মফস্বলে। উনি রাজধানীর সাহিত্য সমাজে আমাকে পরিচিত করেছেন। যদিও আমি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছি ২০০৭ সালে। উনার মতো ভালো বন্ধু আর হয় না। তার কল্যাণেই আমার প্রথম বই বের হয়েছিল। এটি পশ্চিমবঙ্গে প্রশংসা পেল। কিন্তু মার্কসবাদ বিরোধী যারা তাদের প্রচন্ড ভাবে থাক্কা দিলো। মার্কসবাদ বিরোধী লেখক অশ্রু কুমার সিকদার। তিনি অধ্যাপক। তিনি আমার এই বইয়ের প্রবন্ধগুলোকে তুলোধুনো করে ফেললেন। একটি প্রবন্ধ লিখলেন তিনি সেটা চতুরঙ্গ পত্রিকায় বেরিয়েছে। 

অপরূপ বাংলা : বাংলা একাডেমিতে তো তিনি এসেছিলেন?
অধ্যাপক যতীন সরকার : হ্যাঁ, সেখানেই তাঁর সাথে দেখা হয়েছিঁল। আমি তাকে বললাম, ‘আমি তো মার্কসবাদী। মার্কসবাদ বিরোধীদের যে আমি ধাক্কা দিতে পেরেঁিছ এটা আমার বড় গৌরব বলে আমি মনে করি। আমি মার্কসবাদ নিয়ে যে  কথা বলেছি কোনো মার্কসিস্ট তো তা বলে নাই। আপনি বলেছেন। আমি ধাক্কা দিতে পেরেছি এর জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাই। প্রথম বইটি বের হওয়ার পরে অনেক প্রস্তাব আসতে লাগলো। আমাকে লিখতে হবে। আবার আমার লেখালেখির উপরে বিশ^াস খুব কম।  আর আমি নিজেকে বলি কষ্ট লেখক। কষ্ট করে লিখি। 
অপরূপ বাংলা : স্যার, লেখক মাত্রই তো কষ্ট করেন। আপনার ক্ষেত্রে এটা কি রকম, স্যার?   
অধ্যাপক যতীন সরকার : কি রকম, যেমন আমি একটা লেখা শুরু করলাম, দেখা গেলো একটা শব্দ আমার পছন্দ হচ্ছে না। এই শব্দের বদলে আরেকটা কিছু শব্দ দেওয়া দরকার। এক মাস পর্যন্ত আমি ভাবছি।  তারপরে একটা শব্দ পছন্দ হয়। তারপর লেখাটা শেষ করেছি। আমি রাত ২ টা পর্যন্ত লেখালেখি করতাম। কারণ হলো আমি একদিক দিয়ে লিখি আরেক দিক দিয়ে কাটি। কাটাকুটি করতে সময় বেশি লেগে যায়। তখন তো এতো যন্ত্রপাতির সুবিধা ছিল না। আমার সাথে এখন পর্যন্ত যন্ত্রের সংযোগ খুব কম। আমি কেবল এই মোবাইলটা ব্যবহার করতে পারি। এর বেশি কিছু না। কিন্তু আমি ছেলেবেলা থেকেই প্রচুর পড়াশুনা করি।  আমি যখন প্রাইমারী স্কুলের ছাত্র। ক্লাস ফোরে পড়ি।  সেই সময় আমি শরৎচন্দ্রের অনেক লেখা পড়ে ফেলেছি।  আমি মেট্রিক পাশ করেছি ১৯৫৪ সনে। ১৯৫৩ সালে পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। অসুস্থ হয়ে পরীক্ষা দিতে পারি নাই। মেট্রিক পরীক্ষার সময় থেকেই আমি বঙ্কিমের উপন্যাস তো বটেই তার প্রবন্ধ পড়ে ফেলেছি। আমার বাবা আমার ঠাকুরদা তারা আমাকে পড়াশুনায় উৎসাহিত করতেন। আমার বাবা বলতেন, সকালে আর সন্ধ্যায় পাঠ্যপুস্তক পড়বে।  আর সারাদিন অন্যান্য পড়াশুনা।  এরকম ভাবে পুস্তক পড়তাম। অনেক নিষ্দ্ধি বইও পড়তাম। যেমন  ক্লাস টেনে পড়ার সময়েই  আমার কাছে এলো ‘যৌন বিজ্ঞান’। আবুল হাসনাতের লেখা। আবুল হাসনাতের যৌন বিজ্ঞান আমার টেবিলে আছে।  আমিও পড়ছি। আমার বাবাও পড়ছে। এ রকম দৃষ্টান্ত কেউ দিতে পারবে বলে আমার জানা নেই। ভোর বেলায় আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলে দুনিয়ার যত কথাবার্তা তিনি আমার কাছে বলতেন। সাহিত্য সম্পর্কে, রাজনীতি সম্পর্কে। এভাবে আমি রাজনীতি সচেতন হয়ে উঠি।  আর আমার ঠাকুরদা আমাকে ছোট বেলা থেকে বইয়ের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন।

অপরূপ বাংলা : আপনার পরিবারে সংস্কৃতিবান মানুষ হওয়ার জন্য সুন্দর অনুকুল পরিবেশ ছিল স্যার, তাই না? রাজনৈতিকভাবেও কি সচেতন ছিলেন তাঁরা? 
অধ্যাপক যতীন সরকার : তা অবশ্যই বলা যায়। 
অপরূপ বাংলা : আপনার পরিবার নিয়ে আরো কিছু বলেন, স্যার।

অধ্যাপক যতীন সরকার : আমার বাবা একা ছিলেন। বাবার কোনো ভাইবোন ছিল না। আমার জন্মের আগে আমারও এক  বোন হয়ে মারা যায়। ফলে আমাদের বংশবোধ লোপ হয়ে গেলো এরকম একটা আশংকা দেখা দিল।  তখন আমার ঠাকুরমা বিভিন্ন দেবতার মন্দিরে  মানত করে, এমন কি মুসলমান পীরের দরগায় মানত করে যেন আমাদের বংশটা রক্ষা হয়। আমার যখন জন্ম হলো তখন ধাত্রী মুখে শুনেছি আমার ঠাকুরদা যখন শুনলেন আমার জন্ম হয়েছে তখন তিনি বললেন আজ থেকে আমাদের শান্তি হলো। এ কারণে আমার আরেক নাম শান্তি। আমার ডাক নাম কিন্তু শান্তি। এবং শান্তি নামেই এখনো আমার এলাকায় মানুষ চিনে। আমার জন্ম তখনকার নেত্রকোনা মহকুমার একটা কেন্দুয়া থানার চন্দ্রপাড়ায়।  চন্দ্রপাড়ার কাছে হলো রামপুর। ওই স্কুলেই আমি পড়েছি। রামপুরে মোটামুটি আমি থাকতাম। রামপুরে আমার বাবা একটা ছোট্ট বাড়ি করেছিলেন। আমার বাবা হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক ছিলেন। আমরা বলতে গেলে খুবই দরিদ্র ছিলাম। কিন্তু বিত্তহীন হলেও বিদ্যা শিক্ষায় আমাদের কোনো খাদ ছিল না।   সময় পেলেই আমার ঠাকুরদা আমাকে নিয়ে বসতেন। আমাকে খেলাধুলা করতে দেয়া হতো না। খেলাধুলা করলে আমার বংশ লোপ পেয়ে যাবে।  আমি গাছে উঠতে পারি না।  ভাটি এলাকার মানুষ। তারপরও ছেলেবেলায়  ভালো করে সাঁতারট শিখতে পারি নাই।  এভাবে তিনি আমাকে আগলে রাখতেন। তিনি আমাকে পড়তে সাহায্য করতেন।  ধর্ম সম্পর্কে পড়ার যে সূত্রপাতটা, ধর্ম সম্পর্কে আমার যে আগ্রহ এটা আমার ঠাকুরদাই আমার মধ্যে জে¦লে দিলেন। সেই সময়, এটা কেউ বিশ^াস করবে কিনা জানি না, ছয বছর বয়সে আমি কীত্তিবাসের রামায়ণ পড়ে ফেলেছি। এভাবে আমার পড়াশুনা অগ্রসর হয়েছে।  আমি এতো পড়া পড়েছি, এতো বই পড়েছি যে মেট্রিক পাশ করার আগেই আমি বঙ্কিম রচনাবলি পড়ে শেষ করেছি। এভাবে প্রচুর পড়াশুনা হয়েছে। এটা রবীন্দ্রনাথের কবিতার মধ্যে আছে- 
‘অপাঠ্য সব পাঠ্যপুস্তক সামনে আছে খোলা
কর্তৃজনের ভয়ে কাব্য কুলঙ্গিতে তোলা।’
রবীন্দ্রনাথের এ কথা আমার এখানে সত্য না। আমার এখানে আমার কর্তৃজনেই অপাঠ্য পুস্তক পড়তে আগ্রহী করে তুলেছেন। আমার বাবার কথায় আমি সকাল-বিকাল একাডেমিক পড়াশুনা করেছি আর সারাদিনই আমি পড়তাম অন্যান্য বই। ঠাকুরদা আমাকে নানারকম বই পড়তে আগ্রহী করে তুলেছেন। নবী-রসুল, দেবতাদের জীবনী পড়েছি এবং ধর্ম সম্পর্কে সেই সময়ে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। 
অপরূপ বাংলা : ধর্মটা আসলে কি, স্যার? ধর্ম নিয়ে একটু বলুন, স্যার।
অধ্যাপক যতীন সরকার :  আমি বলি ধর্ম শব্দটাই খুব বিতর্কমূলক। কারণ বাংলায় যেটাকে ধর্ম বলা হয়, এটার সত্যিকারের কোনো ইংরেজি নেই।  মানুষের ধর্ম মনুষ্যত্ব।  কিন্তু হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, মুসলমান এগুলো যে ধর্ম এটা কি করে হয়?  ইংরেজি আছে তার রিলেজিয়ান। কিন্তু রিলিজিয়ানের সত্যিকার অর্থে কোনো বাংলা নাই।  রবীন্দ্রনাথ রিলিজিয়ানের একটা শব্দ বের করতে চেয়েছিলেন।  তার একটা লেখার মধ্যে লিখেছেন।  ধর্ম হলো মূল।  আর রিলিজিয়ান যেটা সেটার নাম উনি দিলেন ‘ধর্মতন্ত্র’। এই কথাগুলি আমার একটা বইয়ের মধ্যে আছে। তিনি বলেছিলেন, ধর্ম মানুষকে অগ্রসর করে নেয় আর ‘ধর্মতš’¿ মানুষকে বেঁধে ফেলে। এ ধরনের লেখা তিনি লিখেছেন। ধর্মতন্ত্রের বিরুদ্ধেই তার কথাবার্তা ছিল। রবীন্দ্রনাথ ‘মানুষের ধমর্’ বলে যে বই লিখলেন বাংলা। ইংরেজি করতে গিয়ে তো তিনি নিজেই বিপদে পড়ে গেলেন। মানুষের ধর্মের ইংরেজি কি? ‘রিলিজিয়ন অব ম্যান’  রিলিজিয়ন ম্যান বলে নিশ্চয় কোনো ম্যান নেই।  মানুষের ধর্ম বাংলায় যে অর্থে বলা হয়েছে ইংরেজিতে রবীন্দ্রাথও খুঁজে পাচ্ছিলেন না। দুটো মিনিট পরে বলি, ভাই।
অপরূপ বাংলা : ঠিক আছে স্যার, বলেন।  
অধ্যাপক যতীন সরকার : এখন বলতে পারব, বলি। এখানে ধর্ম শব্দ ব্যবহার না করে বলতে হবে রিলিজিয়ান। এর কোনো বাংলা নাই। এই রিলিজিয়ান মানুষকে নানাভাবে  পিছন দিকে টেনে নেয়।  ধর্ম মানুষকে সামনের দিকে নিয়ে যেতে চায়। রবীন্দ্রনাথ এই কথাটাই বলতে চেয়েছেন। কাজেই প্রথম রিলিজিয়ান, এইটা মানুষকে কি করে?  মানুষকে যে পিছনের দিকে টেনে নিয়ে যায়,  মানুষে মানুষে বৈষম্য সৃষ্টি করে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই।  রবীন্দ্রনাথ নিজেও  কবিতার মধ্যে লিখেছেন- 
‘নাস্তিক সেও পায় বিধাতার বর/ধার্মিকতার করে না আড়ম্বর/শ্রদ্ধা করিয়া জ¦ালে বুদ্ধির আলো/ শাস্ত্রে মানে না, মানে মানুষের ভালো।/ ধর্মের বেশে মোহ এসে যারে ধরে/ অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে/। 
কাজেই মানুষের অকল্যাণে ধর্ম নয়, তার চেয়ে বরং নাস্তিকতা অনেক  ভালো-এই কথাটা রবীন্দ্রনাথই বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ যদি আমরা পড়ি তাহলে দেখতে হবে-তিনি ঈশ^র বিশ^াসী ছিলেন। তার ঈশ^র বিশ^াস এক জায়গায় আটকে থাকে নাই। যেমন গীতাঞ্জলির একটি কবিতার মধ্যে আছে-
ভজন পূজন সাধন আরাধনা
      সমস্ত থাক্ পড়ে।
রুদ্ধদ্বারে দেবালয়ের কোণে
      কেন আছিস ওরে।
অন্ধকারে লুকিয়ে আপন মনে

কাহারে তুই পূজিস সংগোপনে,
নয়ন মেলে দেখ দেখি তুই চেয়ে
      দেবতা নাই ঘরে।
             তিনি গেছেন যেথায় মাটি ভেঙে
                   করছে চাষা চাষ--
             পাথর ভেঙে কাটছে যেথায় পথ,
                    খাটছে বারো মাস।
             রৌদ্রে জলে আছেন সবার সাথে,
             ধুলা তাঁহার লেগেছে দুই হাতে;
             তাঁরি মতন শুচি বসন ছাড়ি
                    আয় রে ধুলার 'পরে।

মুক্তি? ওরে মুক্তি কোথায় পাবি,
       মুক্তি কোথায় আছে।
আপনি প্রভু সৃষ্টিবাঁধন 'পরে
       বাঁধা সবার কাছে
রাখো রে ধ্যান, থাক্ রে ফুলের ডালি,
ছিঁড়ুক বস্ত্র, লাগুক ধুলাবালি,
কর্মযোগে তাঁর সাথে এক হয়ে
       ঘর্ম পড়ুক ঝরে। 

গীতাঞ্জলিতে ঈশ^রকে অঞ্জলি  দিতে গিয়ে তিনি মানুষের কথাটা এই ভাবে নিয়ে এসেছেন। রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবনের কবিতা ‘ওরা কাজ করে’ মধ্যে এবং ‘ঐকতান’ বলেছেন,

আমার কবিতা, জানি আমি,
  গেলেও বিচিত্র পথে হয় না নাই সে সর্বত্রগামী । 
কৃষাণের জীবনের শরিক  যে জন,
 কর্মে ও কথায় সত্য আত্মীয়তা করেছে অর্জন,
 যে আছে মাটির কাছাকাছি, 
সে কবির বাণী-লাগি কান পেতে আছি।
অপরূপ বাংলা : খুবই বিমোহিত হলাম, স্যার! এতো সুন্দর করে বললেন, স্যার! মনে হচ্ছে আপনি আবৃত্তিকার! কী চমৎকার অর্জন! ফুলে-ফলে ভরা কী মোহনীয় জীবন আপনার! 

অধ্যাপক যতীন সরকার : জীবনভর যা চেষ্টা করেছি তাই বলছি।  রবীন্দ্রনাথ মাটির কাছাকাছি থাকতে পারেন নাই বলে নিজেই দু:খ প্রকাশ করেছেন। তবে সুকুমার সেন একটা সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, একটা দেশে সত্যিকারের কবি এক হাজার কি দেড় হাজার বছর পর পর একজন করে আসেন।  আমাদের ভারতবর্ষে প্রথম সত্যিকারের কবি কালিদাস। কালিদাসের দেড় হাজার বছর পরে রবীন্দ্রনাথের জন্ম। রবীন্দ্রনাথের  পরে এখন পর্যন্ত সত্যিকার অর্থে আর কোনো কবি নাই। তবে যাঁরা কবিতা লেখেন তাঁরা করেন কি ওই ধারাটাকে বজায় রাখেন। একটা কথা আমি বলবো নির্মলেন্দু গুনের অনেক অবদান বাংলা কবিতায় রয়েছে। তিনি যখন ‘হুলিয়া’ কবিতাটা লেখেন, তার যে ধারাটা আমি দেখেছি, শামসুর রাহমান আগে যে সমস্ত কবিতা লিখেছেন, নির্মলেন্দু গুনের পরে তিনি যে সব কবিতা লেখেন সে সব কবিতার মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। শামসুর রাহমান মানুষের কবি হিসেবে বেরিয়ে আসেন ৬৯ এর পরে। এটা বললে অনেকেই অখুশী হবে যে শামসুর রাহমানের ধারাটা নির্মলেন্দু গুন বদলে দিয়েছেন। আমি এই কথাটাই বলি। নির্মলেন্দু গুনের কবিতা হচ্ছে এমন কবিতা যা কবিরা ছাড়াও অন্যরা বোঝে।  সুকুমার বড়–য়া ছড়াকার। আমি বলি সুকুমার রায়ের উত্তর সাধক হচ্ছে সুকুমার বড়–য়া।  তিনি তার একটি ছড়ার মধ্যে সুন্দর করে বলেছেন- 
‘এক কবিতে কাব্য লিখেন আরেক কবি বোঝেন/বাদ বাকিরা খাটিয়ে মাথা মর্ম বাণী খোঁজেন/ মর্ম বাণী খুঁজতে গিয়ে ব্যর্থ যদি হন/ কবি বলে কাব্য বোঝার যোগ্য সবাই নন।’
আরেকটা বিষয় এখানে বলা প্রয়োজন। ওটা হচ্ছে ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যয়। তিনি কেবল মার্কসবাদী বললে ভুল হবে। তিনি পাভলীয় মনোবিজ্ঞানকে বাংলায় নিয়ে এসেছেন। পাভলীয় মনোবিজ্ঞানের মধ্য দিয়ে মার্কসবাদ অনেক উন্নত হয়েছে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু পাভলীয় মনোবিজ্ঞান নিয়ে আমাদের সাধারণ মানুষ বা লেখকদের মধ্যে প্রায় ধারণা নাই বললেই চলে। ধীরেন্দ্রনাথ  গঙ্গোপাধ্যায় অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিলেন গুড়া দুধ তৈরি করা শিখতে।  এ সময়ে তিনি যে বাড়িতে থাকতেন সেখানে একজন লোক আগে থাকতেন, তিনি ঐ বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার সময় একটি বই ফেলে গিয়েছিলেন। এই বইটির সংকলন  দেখে তার মাথা থেকে গুড়া দুধ তৈরির চিন্তা চলে গেলো। তিনি স্বদেশে ফিরে এলেন এবং রুশ দেশের রাষ্ট্রদূতের সাথে দেখা করলেন। তিনি রুশ ভাষা শিখলেন। এই পাভলীয় মনোবিজ্ঞানকে তিনি বাংলা সাহিত্যে নিয়ে এসেছেন।  পাভলীয় পরিতিনি নামে একটা বই বের করেছেন। তার বই আছে ‘বিচ্ছিন্নতার ভবিষ্যত’ নামে। 
তিনি যেভাবে পাভলীয়কে বাংলা সাহিত্যে তুলে ধরলেন এটা অনেকেই বোঝে না। ধীরেন্দ্রনাথের নামই অনেকে জানেন না। তার লেখা আমাদের দেশে আসছে। কিন্তু যারা পড়ে তারা কিছু বোঝে না। বোঝে না কারণ এটার জন্য যে ভিত্তি দরকার সেটা তাদের নেই।  আমার সেই ভিত্তিটা ছেলেবেলা থেকেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল। বুঝতে পারলেন আপনারা?
অপরূপ বাংলা : বুঝতে পারলাম, স্যার।

অধ্যাপক যতীন সরকার : আরো শুনেন, ১৯৬৫ সনের দিকে তখন আইয়ুব খানের রাজত্ব। তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আমাদের দেশে বই আসতো। একটা অদ্ভুত ব্যাপার! সেইখানে সোভিয়েত ইউনিয়নের বইগুলির মধ্যে একটা বই আমি খুব মনোযোগ গিয়ে পড়লাম। ‘সাইক্লোলজি এ্যাজ ইউ মে লাইক ইট’। গল্পের মতো করে লেখা। বইটা পড়ে আমি অত্যন্ত মুগ্ধ হলাম। পাভলীয় মনোবিজ্ঞান বোঝার জন্য এই বইটা অত্যন্ত প্রয়োজন। তারপর সোস্যাল সাইকোলজি দৃষ্টি এই বইগুলো পড়লাম। এরপরে যখন খবর পেলাম কলকাতাতে ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় নামে একজন ব্যক্তি পাভলীয় ইনস্টিটিউট করেছেন। তখন আমি তাঁর সাথে যোগাযোগ করার জন্য চেষ্টা করতে লাগলাম। 
আমি পাভলীয় মনোবিজ্ঞান যতটুকু বুঝলাম তার ওপর ভিত্তি করে আমি একটা লেখা লিখলাম। লেখাটার শিরোনাম যতদুর মনে পড়ে ছিল ‘সাহিত্য-ইতিহাস ব্যাখ্যায় পাভলভীয় মনোবিজ্ঞান’ এই ধরনের। ফরিদপুরে সাহিত্য সম্মেলন হয়েছিল সেই সম্মেলনে আমি এটা পাঠ করেছিলাম। ওখানে যারা মঞ্চে ছিলেন তারা বললেন, এটা তো মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা। বেশ ভালো লেখা। এখানে যদি মার্কসবাদ নিয়ে আলোচনা হতো তাহলে ভালো হতো। আর নিচে যারা বসেছিলেন তারা বললেন, আপনি এটা কি লিখেছেন আমরা কিছু বুঝিনি। আমি বল্লাম, আমিও বুঝি নাই। লেখাটা ঠিক হলো কিনা, ধীরেন্দ্রনাথ যদি  এটা অনুমোদন করে তাহলে এটা সঠিক বলে ধরে নেয়া যায়। এটি পরে বাংলা একাডেমি থেকে ছাপা হয়েছিল। তারপরে  আমি সেই লেখাটা একজনের মাধ্যমে ধীরেন্দ্র নাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে পাঠিয়ে দিলাম। তার যে পাভলভ ইনস্টিটিউট আছে সেখানে। উদ্দেশ্য হলো লেখাটা ঠিক আছে কিনা ওটা জানা। ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ‘মানব মন’ নামে একটা পত্রিকা বের করতেন। যেখানে পাভলভীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মানব মনের ব্যাখ্যা ইত্যাদি লেখা থাকতো। ওখানে যে সমস্ত লেখা তার অধিকাংশ নিজেই লিখতেন। অন্যের লেখা ছাপা হলে নিচে ফুটনোট দিতেন।  যেখানে লেখা থাকতো এই বিষয়টি পাভলভীয় মনো বিজ্ঞান নয়। এটি এ রকম হবে। ধীরেনন্দ্রনাথ আমার সেই লেখাটা দেখলেন। আমার এক ছাত্র নিয়ে গিয়েছিল। উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখে বললেন, ভালো  তো, ভালো তো, আমি এটা দেখব। আমার  ধারণা ছিল তিনি একটা কিছু মন্তব্য করবেন। দেড় বছর চলে গেলো কোনো খবর নাই। আমি ধারণা করে নিলাম লেখাটা আমার হয়নি। হঠাৎ দেড় বছর পরে একটা পোস্ট কার্ড এলো।  যতীন সরকার, ময়মনসিংহ এই ঠিকানায়। চিঠিতে লেখা ‘আপনার লেখাটি আমরা মানব মনে পুনর্মুদ্রন করতে চাই। অনুমতি দিয়ে বাধিত করবেন।’ আমি বললাম বাধিত করবো না, আমি যে কত বাধিত হবো সে বলে শেষ করতে পারব না। এরপর আমি তাঁকে একটা চিঠি লিখলাম। তিনি জবাব দিলেন। তিনি বললেন, আমরা বাংলাদেশের কোনো লেখা ছাপিনি। তবে এ ধরনের লেখা পেলে ছাপবো। তারপর তিনি যখন ছাপলেন তখন ধারণা করে নিয়েছিলাম তিনি ফুটনোট দিবেন যে, এই লেখাটি পাভলভীয় মনো বিজ্ঞান সম্মত নয়। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, আমার এটাতে তিনি কোনো মন্তব্য করেন নাই। নিচে শুধু পরিচয় দিয়েছেন যতীন সরকার, নাসিরাবাদ কলেজ, ময়মনসিংহ। এই ঘটনায় আমার কনফিডেন্স হয়ে গেলো।  আমি মোটামুটি ভাবে পাভলভীয় মনোবিজ্ঞান বুঝেছি। আমি এখন যা কিছু লিখবো তা পাভলভীয় মনোবিজ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে। আমি নিজেকে দ্বান্দিক বস্তুবাদের ছাত্র বলি। 
অপরূপ বাংলা : এখনো নিজেকে ছাত্র মনে হয়, স্যার!
অধ্যাপক যতীন সরকার : অবশ্যই আমি এখনো ছাত্র! দ্বান্দিক বস্তুবাদ আমার জীবন দর্শন। সেই দ্বান্দিক বস্তুবাদকে বুঝতে হলে যে মনোবিজ্ঞান বোঝা দরকার তা অনেক কমিউনিস্টরা বোঝে না।  অনেকেই বোঝে না। বোঝেনা বলেই মার্কসবাদের খ-ীভবন হয়। সোভিয়েন ইউনিয়নের পতনের পরে আমি একটা প্রবন্ধে লিখেছিলাম সোভিয়েত ইউনিয়নের পাভলভীয় মনোবিজ্ঞানের যে ধরনের আলোচনা করা হয়েছে তা গ্রহণ করে নাই। যদি করতো তাহলে সোভিয়েত ইউনিয়নের এ ধরনের পতন হতো না।  লেখাটা ছিল ‘মার্কসবাদের খ-ীভবন ও সমাজতন্ত্রের সংকট’। এখানে বলেছিলাম মনোবিজ্ঞানকে বাদ দিয়ে দ্বান্দিক বস্তুবাদ হবে যান্ত্রিক বস্তুবাদ। মার্কসবাদ দ্বান্দিক বস্তুবাদ হয়ে গিয়েছিল। সেখানে পাবলভকে নিয়ে যথার্থ আলোচনা হয় নাই। তবে আমরা দেখেছি ১৯৫৩ সনে লেনিন তখন ছিলেন। তখন পাবলভীয় মনোবিজ্ঞান নিয়ে একটা সেমিনার হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে। এই সেমিনারে আমেরিকা থেকে একজন লোক গিয়েছিলেন। সেই ভদ্রলোক একটা সেমিনারকে কেন্দ্র করে একটি লেখা লিখলেন, লেখাটা আমি পড়েছি। সেখানে তিনি বললেন, পাবলভীয় মনোবিজ্ঞান না জানলে সত্যিকার অর্থে মার্কসবাদ  বোঝা যায় না। তারপরে তার সম্পর্কে আরো আগ্রহবোধ করি। লেখা পাঠালাম ধীরেন্দ্রনাথের কাছে। এরপর থেকে আমি যা কিছু লিখেছি মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে। তবে মার্কসবাদ বললে যথেষ্ট বলা হয় না। পাবলভীয় মনোবিজ্ঞানের সাথে যুক্ত রেখে আমি আমার সমস্ত লেখা লিখেছি। 
অপরূপ বাংলা : স্যার, আপনি কোনো গল্প, উপন্যাস লিখেছেন?
অধ্যাপক যতীন সরকার : আমি বলি, গল্প উপন্যাস কবিতা যারা লিখেন তারা প্রতিভাবান। প্রতিভা হচ্ছে সংস্কৃত অলংকার শাস্ত্রমতে, ‘অপূর্ব বস্তু নির্মাণ ক্ষমতা সম্পন্ন প্রজ্ঞা’ । অপূর্ব বস্তু নির্মাণের ক্ষমতা সম্পন্ন প্রজ্ঞাকেই ‘প্রতিভা’ বলে। গল্প, উপন্যাস যারা লিখেন তাদের অপূর্ব বস্তু নির্মাণের ক্ষমতা রয়েছে। আমার অন্তত এই ক্ষমতাটা আছে, আমার যে প্রতিভা নাই এইটা  আমি বুঝি। অনেকেই সেটা বোঝে না। ওই যে কবির সংখ্যা এতো বেশি যে, এরকম মনে হয় সাহিত্যের আর কোনো শাখায় নেই।  বাংলা একাডেমির বইমেলায় যত বই বের হয় সব থেকে বেশি বের হয় কবিতার বই। আবার বিক্রিও হয় সবচেয়ে কম। তবে আমি বলি সাহিত্যের যে ধারাটা চলে তার মধ্যে  আঁকাবাঁকা থাকবেই।  সেই আঁকাবাঁকা হয়েই চলছে। কোনো সময়ে মনে হবে এটা বুঝি পেছনে চলে গেলো। কবিতা যে আমি লিখতে পারি না। এটা আমি জানতাম এবং বুঝতাম।  আমার মধ্যে যে প্রতিভা বাস্পমাত্রও নাই,  এটাও বুঝি। তাহলে প্রবন্ধ লিখলাম কেন? আমি প্রবন্ধ লিখেছে এই কারণে যে, প্রবন্ধ সবাই লিখতে পারে। ক্লাস ্েটনে যখন পড়তাম তখন থেকেই তো  আমরা প্রবন্ধ লিখি। পরীক্ষায় আসতো নি¤েœর যে কোনো একটি বিষয় নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখ। যেমন পরীক্ষার পূর্বরাত্রী। তোমার জীবনের লক্ষ্য কি? এগুলোই তো প্রবন্ধের বিষয়বস্তু। কাজেই প্রবন্ধ ছাড়া অন্য কিছু লেখার ক্ষমতা আমার নাই এটা আমি বুঝি। শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুন, আল মাহমুদকে কবি বলা যায়।  সুকুমার সেন যে বলেছিলেন এক হাজার বছরে একজন কবি জন্ম গ্রহণ করে। তাঁর কথাটাকে আমি সমর্থন করি। কালিদাসের পরে রবীন্দ্রনাথ। এর পরে সত্যিকার অর্থে যে কবি হবে, তার সংখ্যা নেই বললেই চলে।
অপরূপ বাংলা : জীবনানন্দ দাশ ও বিদ্রোহী কবি নজরুলকে নিয়ে একটু বলেন। 
অধ্যাপক যতীন সরকার : জীবনানন্দ দাশ সম্পর্কে আমি কিছু বলতে চাই না। তিনি আধুনিক কবি। কিন্তু তিনি যে অর্থে আধুনিক, জীবনানন্দ কিংবা বুদ্ধদেব বসু, সুধীন দত্ত এই অর্থে নজরুল আধুনিক নন। তবে আধুনিক সাহিত্যে নজরুলের একটা বিরাট অবদান আছে বলে মনে করি।  রবীন্দ্রনাথের পরে যদি কোনো সাহিত্যিকের কথা বলতে হয় তাহলে নজরুলের কথা বলতেই হবে।  নজরুল এটা কোত্থেকে পেয়েছিলেন?  আমি বলি প্রাকৃতজনের জীবন দর্শন বলে আমার যে বই আছে। প্রাকৃতজনের মধ্যে যারা থাকে, প্রাকৃতজনের কাছ থেকে যারা একটা কিছু গ্রহণ করেন তারাই প্রকৃত সাহিত্যিক। সেই অর্থে নজরুল প্রকৃত সাহিত্যিক। প্রাকৃতজন হচ্ছে তারাই যারা প্রকৃতজন। যারা উপরিস্তরে আছেন তারা প্রকৃত নয়, প্রাকৃতজন নয়। সুধীন দত্ত তাঁর ভাষায় বলেছেন- “বিশে^র সেই আদিম উর্বরতা যার নেই, সারা ব্রহ্মা-  থেকে বীজ সংগ্রহ করলেই কাব্যের কল্প তরু জন্মায় না।” সুধীন দত্ত যখন এই কথা বলেন,  তখন বোঝা যায়, সারা ব্রহ্মা- থেকে বীজ সংগ্রহ করে আনতে হয় না। আমার দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে, প্রাকৃতজনকে যদি সাধারণ মানুষ বলি, তাহলে তাদের মধ্যে যা ছড়িয়ে আছে ওটা সংগ্রহ করলেই চলে। বিশ^ব্রহ্মা- থেকে খোঁজ করে আনতে হয় না। বুদ্ধদেব বসু বোদলেয়ারকে নিয়ে কবিতা লেখেন। কেন তাঁকে বোদলেয়ারকে নিয়ে কবিতা লিখতে হবে? তার কারণ বুদ্ধদেব বসুই বলুন, আর পঞ্চ কবিই বলুন, তাঁদের কারো সঙ্গেই বাংলার প্রাকৃতজনের সংযোগ ছিল না।  তবে এই সংযোগ ছিল নজরুলের মধ্যে। নজরুল আসানশোলে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। সেখানে লেটোর দলে যোগদান করেছিলেন। লেটো প্রাকৃতজনের সঙ্গীত। সেখানে তিনি পালা রচনা করেছেন।  তিনি কারবালার কাহিনী দিয়ে পালা লিখেছেন।  মেঘনাদ বধ নিয়ে পালা লিখেছেন।  চাষার সং লিখেছেন।  কাজেই এই ব্যাপারটা সাধারণ মানুষের মধ্যে যেভাবে সাহিত্য বিস্তারিত হয়ে আছে ওটার সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন নজরুল।  নজরুলের মতো এরকম সাধারণ মানুষ, প্রাকৃতজনের মধ্যে থেকে আমাদের আধুনিক কবিদের মধ্যে কেউ উঠে আসেননি। জীবননান্দ ও নজরুল সামাগ্রিক ভাবে এক নন। জীবনানন্দ দাশরা আধুনিক। বুদ্ধদেব বসুদের সঙ্গেই তাঁর যোগাযোগ। কিন্তু নজরুল আধুনিক নন প্রাকৃতজনের কবি। আমি মনে করি, এই প্রাকৃতজনের কবিই আসল কবি। আমাদের সাহিত্যকে যদি সামনের দিকে অগ্রসর করতে হয় তাহলে প্রাকৃতজনের ধারাটাকেই সামনের দিকে অগ্রসর করে নিয়ে যেতে হবে। দৃু:খের বিষয় গল্প উপন্যাসে কিছু কিছু প্রাকৃতজন আছে কিন্তু কবিতায় প্রাকৃতজন একেবারেই নেই। প্রাকৃতজনের সঙ্গে তাদের সম্পর্কই নাই।
অপরূপ বাংলা : স্যার, বাংলাদেশের তরুণ কবি-সাহিত্যিকদের নিয়ে কিছু বলেন।
অধ্যাপক যতীন সরকার : আমি তো বলি বাংলাদেশের তরুণ কবি-সাহিত্যিক যারা আছেন তারা মূলত মুসলিম। মুসলিমদের সঙ্গে প্রাকৃতজনের যে সম্পর্কটা আছে ওই বুদ্ধদেব বসুদের কিন্তু সেটা ছিল না। কাজেই মুসলিমরা যদি নজরুলের ধারাটা ধরতে পারে, বা এই চিন্তাটা করে তাহলে তাদের হাত দিয়ে সত্যিকারের যে সাহিত্য  এটা বেরিয়ে আসবে বলে আমি মনে করি।  কিন্তু সেই ধারায় কোনো কবি লেখক যান না এবং যান না বলেই আমাদের সাহিত্যে যদি দুর্দশা হয়ে থাকে, এ কারণেই হয়েছে। তবে আমি আশাবাদী এই অবস্থা থাকবে না।  বাংলাদেশ থেকেই বাংলা সাহিত্যের যথার্থ রূপ বেরিয়ে আসবে। 
অপরূপ বাংলা : স্যার, রাজনীতি বাংলাদেশের কবি-সাহিত্যিকদের কোনো সমস্যা করছে? 
অধ্যাপক যতীন সরকার : না, তা না। রাজনৈতিক কারণে নয়, প্রাকৃতজনের সঙ্গে কবি-সাহিত্যিকরা মিশতে পারে না সাংস্কৃতিক কারণে। তাঁরা মনে করে সংস্কৃতিটা উপরতলায় আছে। ভদ্রলোকের সংস্কৃতির মধ্যে আছে। ভদ্রলোকের মধ্যে নয়, প্রাকৃতজনের মধ্যে যে সংস্কৃতি আছে-এটা তাঁরা বুঝে না। এটার সঙ্গে তাঁদের কোনো সম্পর্কই নাই। এই জিনিসটা আমি খুব ভালো করে বুঝি। এই সম্পর্কটা  যদি তৈরি হতো তাহলে আমাদের সাহিত্য সত্যিকার অর্থে যথার্থ সাহিত্য হয়ে উঠতো।  ‘সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা’ আমার  প্রথম বই। আর শেষ বই হচ্ছে, প্রত্যয় প্রতিজ্ঞা প্রতিভা। ৫০ বছর থেকে আশি বছর পর্যন্ত লিখেছি। মোটামুটি এই লাইনটা ধরেই লিখেছি।
অপরূপ বাংলা : স্যার, আপনাকে আমরা অনেক কষ্ট দিলাম। আমরা আপনার কাছে কৃতজ্ঞ।
অধ্যাপক যতীন সরকার : না না এটা কি বলেন! আমি খুশি হয়েছি। সেই ঢাকা থেকে, কতদূর থেকে, এতো কষ্ট করে আপনারা এসেছেন! আমি সত্যিই খুশি হয়েছি। এখন একটু মিষ্টি মুখ করবেন। আপনাদের খুব ধন্যবাদ।
অপরূপ বাংলা : অবশ্যই মিষ্টিমুখ করব, স্যার। আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ স্যার। 
     


 

সর্বশেষ