শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ , ১২ বৈশাখ ১৪৩১

modhura
Aporup Bangla

বিজ্ঞাপন ও সাইনবোর্ডে বাংলা ভাষার ব্যবহার

শিল্প-সাহিত্য

এমরান কবির

প্রকাশিত: ০৯:৩৭, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

সর্বশেষ

বিজ্ঞাপন ও সাইনবোর্ডে বাংলা ভাষার ব্যবহার

চিত্র: রনি বর্মন

বিজ্ঞাপন ও সাইনবোর্ডে বাংলা ভাষা ব্যবহারের বিষয়টি সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহার সংক্রান্ত নির্দেশনার আওতাভুক্ত। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ভাষা আন্দোলনের এত বছর পর এবং এ সংক্রান্ত আদালতের নির্দেশনার পরও আমরা এক্ষেত্রে সফল হতে পারিনি। বরং বাংলা ভাষা ব্যবহার করার মর্ম আমাদের চেতনা থেকে ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে যেন। ফেব্রুয়ারি এলে উৎসব, একুশে ফেব্রুয়ারির দিনে সাদাকালো বস্ত্র পরিধান আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিশ্র ভাষায় স্ট্যাটাস। এসবই এখন আমাদের বর্তমান ভাষা-চেতনা।
বিজ্ঞাপন ও সাইনবোর্ডে ইংরেজির ব্যবহার দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। বাড়ছে মিশ্র ভাষার ব্যবহার। কিন্তু এমনটি যে আইনবিরুদ্ধ তা যেমন এর ব্যবহারকারী জানে না, তেমনি আইন প্রয়োগকারী সংস্থারও কোনো গরজ নেই, শিক্ষিত ও সুশীল সমাজেরও গা-ছাড়া ভাব।
২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুযারি হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ এক আদেশে দেশের সব সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার, গাড়ির নাম্বার প্লেট, সরকারি-বেসরকারি দপ্তরের নামফলক এবং গণমাধ্যমে ইংরেজি বিজ্ঞাপন ও মিশ্র ভাষার ব্যবহার বন্ধ করতে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে বলেন। সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংল্।া এর উপর ভিত্তি করে ১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন প্রণয়ন করা হয়। এ আইনের ২ ও ৩ (১) ধারায় বলা আছে, ‘কর্মস্থলে যদি কোনো ব্যক্তি বাংলা ভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন, তাহলে তা বেআইনি ও অকার্যকর বলে গণ্য হবে।’ ৩ ধারায় বলা আছে ‘ কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী এ আইন অমান্য করলে তা সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধির অধীনে অসদাচরণ বলে গন্য হবে এবং এর বিরুদ্ধে বিধি অনযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ অসদাচরণের শাস্তি চাকরিচ্যুতি। কিন্তু এই আইনের অধীনে কোনো সরকারি, অসরকারি, আধাসরকারি কিংবা স্বায়ত্বশাসিত সংস্থার কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীর শাস্তি হয়েছে বলে শোনা যায়নি। এ আইন মানতে কাউকে বাধ্যও করা হয়নি; এমনকি এরকম যে একটি আইন আছে সে-বিষয়ে কাউকে সজাক করতেও কোনো সরকারকে দেখা যায়নি।
সাইনবোর্ডগুলোতে দেদার ইংরেজি ভাষার ব্যবহার চলছে। সঙ্গে যদি বাংলা ব্যবহার করা হয় তা ভুল বানানে ভরা। যে ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য এত প্রাণ বিসর্জন দিতে হলো, এত ত্যাগ তিতিক্ষা করা হলো তার পরিণাম এরকম দেখলে কার না খারাপ লাগে! কিন্তু তা চলছেই। এবং বেড়েই চলছে। বিলবোর্ড ও ব্যানারেরও একই অবস্থা। গাড়ির নাম্বার প্লেট এখোনো বাংলা হলো না। সরকারি দপ্তরের নামফলকও যদি ইংরেজি ও বাংলার মিশ্রিত ভাষার হয়ে থাকে তাহলে আর কী বলার থাকে। গণমাধ্যম এতই বিজ্ঞাপনভুক যে মিশ্র কেন, হিব্রু ভাষায়ও যদি কোনো কোম্পানি বিজ্ঞাপন দেয় তাও কোনো কর্তন ছাড়াই তারা প্রচার করবে। কারণ বিজ্ঞাপন মানেই তো টাকা। গণমাধ্যমের অনুষ্ঠান উপস্থাপনার ক্ষেত্রেও অর্ধেক বাংলা (তাও বিকৃত উচ্চারণে ও ইংরেজির অনুকরণে) অর্ধেক ইংরেজি ব্যবহারের হেতুবাদ কী হতে পারে তা কে বলবে! এসবের মাধ্যমে ভাষার ব্যবহার কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং কী অনুশীলন করা হচ্ছে ও করানো হচ্ছে, তা কি আমরা ভেবেছি কখনো!
ভাবিনি। ভাবলে আইনের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল হতাম। চেতনার প্রতি দায়বদ্ধ হতাম। দায়বদ্ধ হতাম নিজের বিবেকের প্রতি। অনেক আগেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিষয়টি অনুধাবন করেছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনি বাংলা একাডেমির এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘বাংলা ভাষার পন্ডিতরা পরিভাষা তৈরি করবেন, তারপর বাংলা চালু হবে- সে হবে না। ক্ষমতা নিয়েই সর্বস্তরে বাংলা চালু করে দেব। ভুলই চালু হবে, পরে তা সংশোধন হবে।’ ভাষার প্রতি পাহাড়সমান দরদ না থাকলে এমনটি বলা যায় না।
নানান দেশের নানান ভাষা/ বিনে স্বদেশী ভাষা/ পুরে কি আশা!’ রামনিধি গুপ্তের এই কবিতাংশ শুধু আমাদের জন্য নয়। পৃথিবীর সব মাতৃভাষাভাষী মানুষের কাছেই ধ্রুব সত্য। অথচ আমরা এই ধ্রুবসত্যকে উপেক্ষা করছি। নিজের মাতৃভাষার প্রতি অবজ্ঞা করে কোনো জাতি উন্নতি করতে পারেনি। কবিগুরু কম ইংরেজি জানতেন না। কিন্তু তিনিই তাঁর আমার ছেলেবেলা গ্রন্থে লিখেছিলেন ‘আগে নিজ ভাষার গোড়াপত্তন।’
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সামার ইন্সটিটিউট অব লেঙ্গুইস্টিকের ভাষ্যমতে, পৃথিবীতে এখন ভাষার সংখ্যা ৬,৯০৯টি। এতগুলো ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষার অবস্থান দশের ভেতরে। এটা যে কত বড় গৌরবের বিষয় তা ভাবতেই মন ভরে যায়। আর আমরা কি-না সেই ভাষাকে উপেক্ষা করছি। ভাবলেই গা শিউরে  ওঠে যে, আমরা উপেক্ষা করছি সেই ভাষাকে যে-ভাষার জন্য জীবন বিসর্জন দিতে হয়েছে। পৃথিবীতে আর কোনো উদাহরণ নেই যার।
১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেসকো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করে। এখন পৃথিবীর ৭০টিরও বেশি দেশে তা পালন করাহয়। এই ঘোষণা এবং বিশ্বব্যাপী মাতৃভাষা দিবস পালনের বিষয়টি আমাদের ভাষা আন্দোলনকে একটি বিশেষ মর্যাদার আসনে অধিষ্টিত করেছে।
বিজ্ঞাপন ও বিলবোর্ডে বাংলা ভাষার নির্ভুল ব্যবহার করার মতো জরুরি কাজটি করতে পারে বাংলা একাডেমি, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট, সুশীল সমাজ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। প্রয়োজনে রাস্তায় নেমে উদাহরণ সৃষ্টি করা যেতে পারে। এভাবে মানুষকে সচেতন করলে অন্তত বিজ্ঞাপন ও বিলবোর্ডে বাংলা ভাষার ব্যবহারের বিষয়টি নিশ্চিত হতে পারে।
এতসব মন খারাপের মতো ঘটনার মধ্যে একটি আশার কথা হলো আমাদের উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষার রায় প্রদান শুরু হয়েছে। সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক এ মহৎ কাজটি শুরু করেছিরেন হাইকোর্টে বিচারপতি থাকা কালে। ২০০৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি প্রথম বাংলায় একটি মামলার রায় লেখেন। এরপর প্রায় দুই শ রায় তিনি বাংলায় লেখেন। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হওয়ার পরও তিনি বাংলায় রায় লেখা অব্যাহত রেখেছিলেন। আর বিচারপতি শেখ মোঃ জাকির হোসেন আট হাজার রায় বাংলায় লিখে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
প্রতিষ্টিত হোক বাংলাভাষা, সর্বস্তরে।

জ.ই

সর্বশেষ