বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ , ১১ বৈশাখ ১৪৩১

modhura
Aporup Bangla

ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু ও  শেখ হাসিনা  

মতামত

মো. শফিকুল ইসলাম শফি

প্রকাশিত: ১৩:৫৫, ৩ মার্চ ২০২৪

আপডেট: ১৩:৫৯, ৩ মার্চ ২০২৪

সর্বশেষ

ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু ও  শেখ হাসিনা  

ফাইল ছবি/বঙ্গবন্ধু

মহান ভাষা আন্দোলন বাঙালির জীবনে সবচেয়ে তাৎপর্যময় ঘটনা। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচক হিসেবে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে আখ্যায়িত করা যায়। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব বহু গুণে বেড়েছে। একুশের রক্তস্নাত অধ্যায়ের ফলেই রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার অধিকার  প্রতিষ্ঠার দ্বার উন্মুক্ত হয়।
১৯৪৭ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুরু হয়ে ১৯৫৬ সালে শেষ হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। ১৯৫৬ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শেষ হলেও সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন এবং আমাদের জাতীয় জীবনে ভাষা আন্দোলনের চেতনা আজও বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। মানুষ মননশীল ও সামাজিক জীব। মানুষ তার ভাবনা, ইচ্ছা, আকাঙ্খা ভাষার মাধ্যমে অন্যের কাছে প্রকাশ করতে সচেষ্ট হয়। অর্থাৎ ভাষা মানুষের ইচ্ছা-আকাঙ্খা ও মনোভাব অন্যের কাছে প্রকাশ করার জন্য কণ্ঠধ্বনির সাহায্য গ্রহণ করে। আবার কখনো কখনো হাত, পা, চোখ ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাহায্যে ইঙ্গিত করে থাকে। কণ্ঠধ্বনির সাহায্যে মানুষ যত বেশি পরিমাণ মনোভাব প্রকাশ করতে পারে, ইঙ্গিতের সাহায্যে ততটা পারে না।

আদিম যুগের মানুষ আকার ও ইঙ্গিতে পারস্পরিক ভাবের আদান-প্রদান করত। এভাবেই কালের বিবর্তনে ভাষার উৎপত্তি হয়। মানুষ যেদিন থেকে পৃথিবীতে আছে, ভাষাও সেই দিন থেকেই আছে। কিন্তু আদিমকালের ওই শুরুর ভাষা সাজানো গোছানো ছিল না। মানুষ এখনকার মতো ভাষা পেয়েছে আরো পরে। অভিব্যক্তির নানা পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে মানুষ আজকের ভাষা পেয়েছে।

প্রখ্যাত ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ভাষার জন্ম নিয়ে চমৎকার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ভাষার জন্ম জীবের জন্মের মতো নয়। অমুক সন-তারিখে অমুক ভাষার জন্ম হইয়াছে; এইরূপ কথা বলিতে পারি নাই। ভাষা নদী প্রবাহের ন্যায়। বিভিন্ন স্থানে তাহার বিভিন্ন নাম। যখন একটি ভাষা প্রবাহের মধ্যে কোনো সময়ের তাহার পরবর্তী ভাষাভাষীদিগের নিকট একটি নতুন ভাষা বলিয়া বোধ হয় তখন তাহার নামকরণ হইয়া থাকে।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘ভাষা সম্ভবই হতো না, যদি না মানুষের স্বভাবের মধ্যে ভাষার বীজ থাকত। মানুষের সৃষ্টির সঙ্গেই তার মধ্যে এই ভাষার বীজ রেখে দিয়েছিলো। এই হিসেবে ভাষাকে মানুষের প্রতি সৃষ্টিকর্তার দান বলা যেতে পারে। কিন্তু এই বীজ কী? সেটি হচ্ছে প্রতিটি জিনিসের অনুভূতির সঙ্গে মানুষের গতি প্রবৃত্তি। একটা বাঘ বা সাপ দেখলে মানুষ পালাতে চায়; জল দেখলে তৃষ্ণা নিবারণের জন্য সেদিকে যেতে চায়, মানুষ শব্দ শুনলে শব্দের দিকে কান বাড়িয়ে দেয়। যখনই অনুভূতি স্মরণে আসে, তখনই আগের গতি প্রবৃত্তিও জেগে ওঠে। যখন মানুষের গতি প্রবৃত্তি অঙ্গভঙ্গি থেকে বাগযন্ত্রের গতিতে পরিণত হলো, তখনই প্রথম ভাষার উৎপত্তি হয়। প্রথমে গতি, পরে অঙ্গভঙ্গি শেষে ভাষা। এই হলো ভাষার জন্মকথা।’

পৃথিবীতে অনেক ভাষা আছে। পৃথিবীর সব মানুষ একই বাক-প্রত্যঙ্গের সাহায্যে ধ্বনি সৃষ্টি করে, তবু এক এক গোষ্ঠীর ভাষা শৃঙ্খলা ও ভাষাবৈশিষ্ট্য বিভিন্ন রকম হয়। তাই একেক জাতি ও দেশের ভাষা একেক রকম হয়। আমাদের ভাষার নাম বাংলা ভাষা, আমাদের মাতৃভাষা। মাতৃভাষা হলো সেই ভাষা যে ভাষা মানুষ জন্মের পর থেকেই শোনে, মায়ের কোল থেকে শেখে, পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশ থেকে আয়ত্তে আনে। অর্থাৎ মাতৃভাষা হচ্ছে মায়ের ভাষা। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা, কারণ বাংলা ভাষাতেই আমাদের কথা বলেন। আমাদের জন্মের পর আমরা প্রথম মায়ের কাছ থেকে এই ভাষার কথা বলে আসছি। পৃথিবীর ভাষাগুলোর মধ্যে আমাদের মাতৃভাষা অর্থাৎ বাংলা ভাষার একটি বিশিষ্ট স্থান ও মর্যাদা বিদ্যমান। বিশ্বের প্রায় ২০ কোটি লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে। বাংলা ভাষা পৃথিবীর বড় ভাষাগুলোর একটি। এই ভাষা সারাবিশ্বে সপ্তম বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভাষা হিসেবে স্বীকৃত।

রাষ্ট্রভাষা বিতর্কটি ব্যাপকতা পায় ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টে পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভের পর থেকে। কিন্তু এই বিতর্কের শুরু আরো অনেক পূর্ব থেকেই। বাংলা ভাষাভাষীদের মাতৃভাষা যাতে রাষ্ট্রভাষার আসনে সমাসীন হতে না পারে সে জন্য ষড়যন্ত্র চলেছে দীর্ঘ দিনব্যাপী। বিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ-ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলন ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকলে নতুন করে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকেই স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন, ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলে যাই হোক বাংলাদেশে বাংলাই হবে সরকারি ভাষা।

ভাষা সংগ্রামের প্রথম পথযাত্রা শুরু করে জাতীয় চেতনার যে   বৈপ্লবিক মাটি তারা আমাদের জন্য উর্বর করে তুলেছেন, সেই মাটিতে ক্রমাগত রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বীজ বুনেছি আমরা, চয়ন করেছি স্বাধীনতার ফসল। বায়ান্নর একুশের ভাষা আন্দোলন থেকে সৃষ্ট বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিণতি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভব। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম জাতিরাষ্ট্র। যে রাষ্ট্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারি।
২১ ফেব্রুয়ারি রাতে শেখ মুজিব জেলে বসে ঢাকায় ছাত্রদের ওপর গুলির খবর পান।
বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘মুসলিম লীগ সরকার কত বড় অপরিণামদর্শিতার কাজ করল। মাতৃভাষা আন্দোলনে পৃথিবীতে এই প্রথম বাঙালিরাই রক্ত দিল। দুনিয়ার কোথাও ভাষা আন্দোলন করার জন্য গুলি করে হত্যা করা হয়নি।... আমি ভাবলাম, দেখব কিনা জানি না, তবে রক্ত যখন আমাদের ছেলেরা দিয়েছে, তখন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করে উপায় নাই।’ ২৭ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে মুক্তির ঘোষণা দিয়ে অনশন ভঙ্গ করানো হয়।
ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রাখার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি স্বাধীনতা লাভ করে। আর এরপর টানা ৪ দফায় ক্ষমতায় এসে দেশকে পাল্টে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
গত ১৫ বছর ধরেই দেশের মানুষসহ গোটাবিশ্ব দেখছে বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি, সফলতা ও শেখ হাসিনার ক্যারিশমেটিক লিডারশিপ। চালকের আসনে থেকে পুরো দেশের পুরো চেহারাই বদলে দিয়েছেন তিনি। সরকারের উন্নয়ন-অগ্রগতি ও সাফল্যের নিচে ঢাকা পড়ে গেছে অতীতের চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র ও সাম্প্রদায়িক নেতিবাচক রাজনীতির ইতিহাস। ক্ষমতার এই ১৫ বছরে দেশের মাটিতে কুঁড়েঘর, ছনের ছাউনি কিংবা বিদ্যুৎহীন 
অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশের সেই চিত্র এখন কেবলই ইতিহাস, নিয়েছে জাদুঘরে ঠাঁই। দেশের শতভাগ মানুষের ঘরে এখন বিদ্যুতের রোশনাই, সর্বত্র পাকারাস্তা, পুল-ব্রিজ-কালভার্ট, ফ্লাইওভার, এক্সপ্রেসওয়ে, পদ্মার বুক চিড়ে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল। এসবই বর্তমানে বাংলাদেশের বদলে যাওয়ার বাস্তব চিত্র। দেশের এই সত্যিকারের বদলে যাওয়ার প্রধান রূপকারই হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ‘তলাবিহীন ঝুড়ির’ অপবাদকে চ্যালেঞ্জ করে বাংলাদেশ এখন সারাবিশ্বের সামনে উন্নয়নের রোল মডেল। জাতীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র এবং নানা চড়াই-উতরাই ও অন্ধকারের যুগ পেরিয়ে বাংলাদেশ আজ উন্নয়ন-সমৃদ্ধির মহাসোপানে। দেশ এগিয়ে চলেছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের পথে। স্বাধীনতার পর যে দেশটিকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে কটাক্ষ করা হয়েছিল, সেই বাংলাদেশ আজ গোটাবিশ্বের সামনে এক বিস্ময়ের নাম। যে দলটির নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্থান পায় বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন দেশ হিসেবে, সেই দলটির হাত ধরেই গত ১৫ বছরে বিস্ময়কর গতিতে ঘুরে দাঁড়ানো, উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিশ্ব স্বীকৃতি আদায়কারী দেশটির নাম এখন বাংলাদেশ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া স্বল্পোন্নত বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে থেকে এগিয়ে চলেছে দুর্বার গতিতে। মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতির কুহেলিকা ছিন্ন করে স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী ও তাদের দোসরদের দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র, জঙ্গীবাদ-সন্ত্রাস-ধর্মান্ধ অপশক্তিকে মোকাবেলা করেই বাংলাদেশ এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পতাকাকে উড়িয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে, ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে দেশকে বারবার ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার ষড়যন্ত্রকারীরা। এছাড়া বর্তমান সরকারের টানা ক্ষমতার তেরো বছরের মেয়াদে দীর্ঘ একুশ বছর ধরে বুক ফুলিয়ে চলা বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীদের বিচার, ফাঁসির দন্ড কার্যকর, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং দন্ড কার্যকরের মাধ্যমে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে উত্তরণের সাহসী পদক্ষেপেরও সাক্ষী এদেশের মানুষ। শেখ হাসিনার সাহসী নেতৃত্ব আর কৌশলী অবস্থানের কারণেই বাংলাদেশ আজ নবপরিচয়ে পরিচিতি পাচ্ছে। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ উন্নয়ন, অগ্রগতির সকল সূচকে যুগান্তকারী মাইলফলক স্পর্শ করেছে। অর্থনীতি ও আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার সকল দেশকে ছাড়িয়ে সারাবিশ্বে অগ্রগতির অভূতপূর্ব স্মারক বহন করছে। প্রাণঘাতী করোনা মহামারীসহ শত প্রতিকূলতার মধ্যেও এগিয়ে যাওয়ার রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। আওয়ামী লীগ সভাপতি হিসেবেও দেশকে উন্নয়ন-অগ্রগতির মহীসোপন দিয়ে এগিয়ে নিয়ে গত ১৫ বছরে রাজনৈতিকভাবেই শুধু কোণঠাসাই নয়, অস্তিত্বের চরম সঙ্কটের মুখে দাঁড় করিয়েছেন প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নতুন মুখোশ নিয়ে আবির্ভূত হওয়া যুদ্ধাপরাধী-স্বাধীনতাবিরোধী বিএনপি-জামায়াত-ঐক্যফ্রন্টের জোটকে। ক্ষমতার টানা এই ১৫ বছরে দেশের উন্নয়ন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গেছেন যে, একাত্তরের পরাজিত পাকিস্তানও এখন বাংলাদেশ হতে চায়।

লেখক : সংসদ সদস্য এবং স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রনালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি। 

সর্বশেষ