শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ , ৫ বৈশাখ ১৪৩১

modhura
Aporup Bangla

বই আলোচনা : আইয়ুব মুহাম্মদ খানের ‘যে কখনো ভালোবাসে’ : ফারহান ইশরাক

শিল্প-সাহিত্য

ফারহান ইশরাক

প্রকাশিত: ১৮:০৬, ১৩ ডিসেম্বর ২০২২

সর্বশেষ

বই আলোচনা : আইয়ুব মুহাম্মদ খানের ‘যে কখনো ভালোবাসে’ : ফারহান ইশরাক

অলংকরণ : জীবন শাহ

আইয়ুব মুহাম্মদ খানের ‘যে কখনো ভালোবাসে’ উপন্যাস পাঠে জীবনের কতিপয় মৌলমানবিক রূপভঙ্গিমা, ক্রমপ্রসারমাণ রহস্যপরতা ও বাস্তবতার উৎপীড়ন সানন্দচিত্তে অবলোকন করা গেল। 
.
সাধারণ রসভোক্তা হিসেবে আমার যে সামান্য অবলোকন তাতে যেটুকু বুঝেছি, মানুষের হৃদয়কে জাগতিক বিশালতার সঙ্গে যুক্ত করে দেখার একটা সহজ অন্বেষা ও আনন্দ প্লাবিত করেছে তাঁর রচনার পুরো কলেবর। জীবনের স্বাভাবিক উদযাপন থেকে চয়ন করা যে-সকল রসদসামগ্রী সৃষ্টিময়তার ম্যাটেরিয়াল হয়ে এখানে এসেছে, তা খুবই জীবন্ত ও জবরদস্ত বলেই আমার মনে হয়েছে। প্রতিদিন একটু একটু করে অম্লসুধামিশ্রিত যে সাধারণ জীবনটাকে আমাদের যাপন করতে হয়, তার মধ্যেও জুড়ে থাকে অসাধারণত্বের নানা নজির এবং সৃষ্টিপরতার বিচিত্র ইশারা। এই ইশারাচিহ্নগুলো নিজের হৃদয়ের মধ্যে সযত্নে ভিজিয়ে রসসিক্ত করে নিতে পারলে মূল্যবান একটা ব্যবহারিক সত্যের কাছে, এবং/এমনকি মাঝেমধ্যে শিল্পের উজ্জ্বল উপলব্ধির কাছেও পৌছানো সম্ভব। 
.
ঘটমানতার অধীনে থেকেও নিত্য-অনুভূতির সাহায্যে অন্য মাত্রার একটা বিভূতি সঞ্চার করা যায়; এবং এই পুরো আয়োজনই একটা আত্মচাক্ষুষতার খেলা, যা-থেকে দর্শনের উপলব্ধিও জন্ম নিতে পারে। ব্যক্তিসাপেক্ষ অভিজ্ঞতার পটভূমিকা জীবনজগৎ সম্পর্কে এই-যে একটা পরিশোধিত ধারণার উদ্বোধন ঘটায়, এ-ই তো একটা দিনানুদৈনিক কেজো দর্শনের আয়োজন করতে পারে। আইয়ুব মুহাম্মদ খানের যাপনিভজ্ঞতা সম্পর্কে আমার সঠিক পাঠ আছে বলেই তাঁর সংস্পর্শ-সূত্রে আমি তাঁর সৃষ্টিসম্ভাবনার পরিধি সম্পর্কেও একটা সদ্বিবেচনা তৈরি করে নিতে পারি। বৈষয়িক চুম্বকের মধ্যে আকণ্ঠ ডুব দিতে দিতেও বিষয়-উপচানো একটা বিদ্যুৎস্পৃহাও তাঁর সংবেদনার জগতে ঘুরপাঁক খেতে দেখি। এখান থেকেই তাঁর প্রকৃত লেখকসত্তার উৎসারণ, এখান থেকেই তাঁর সৃজনবত্তার আয়োজন, এবং এখান থেকেই তাঁর লেখকত্ব কিংবা ঔপন্যসিকতার সাধ-ও-সাধ্যের ইকুয়েশন গড়ে তোলা আমার পক্ষে সম্ভব।   
.
’যে কখনো ভালোবাসে’ (বস্তুত সকলেই সময়ে সময়ে এই অভিজ্ঞতার মধ্যে নিজেকে দেখতে পায়) শব্দকয়টি আমাদের একটি অতিচেনা গীতিরচনার কাটা অংশ, যা দিয়ে আইয়ুব মুহাম্মদ খানের কথাকাহিনির নামকরণ চুকোনোর কাজটা সম্ভব হয়েছে। একটা বিশেষায়িত উষ্ণ অনুভূতির নামে পুরো ঘটনাক্রমের নামাঙ্কন হয়েছে বটে, কিন্তু খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, কেবল ওই বিশেষ দাহ্যতার উপলক্ষ্যই নয়, জীবনপটের নানা-বৃহৎ খাতের আরো অসংখ্য স্মরণ লক্ষ করা যাবে উপন্যাসের পুরো প্রচেষ্টায়। নিত্যবেলাকার সম্ভাব্যতার মধ্যে কায়দা করে এতে অনেকখানি সৃজনী শক্তির রঙ ফলানো হয়েছে বলেই ভাবা যেতে পারে; অকাট্য আন্তরিকতার একটা গাঢ় সিলমোহরও বসানো হয়েছে সবখানে। গোপন ও দ্শ্যায়ত ভঙ্গিমার যোগসাজসে জীবনের প্রবাহ গাল্পিকতার আশ্রয়ে মুহূর্মুহ সঞ্চারিত হয়ে চলেছে। 
.
প্রকৃতির আপন পটের মধ্যেও অনেক পটরেখার অংকন চোখে পড়বে; এই মানুষবর্জিত জড়জাগতিক লীলাক্রম যাকে আমরা নিরেট চিত্রলীলারূপে দেখতে পারি, তার পরিচয় কেবল বৃহত্তর প্রকৃতিলোকের নিসর্গনাট্য হিসেবেই। কিন্তু আমরা যাকে সাহিত্য বলে ভাবতে অভ্যস্ত হয়েছি তাতে প্রাণসত্তা বা মানুষের ঘটনাই আদের আশ্রয়। মানুষ মানুষের সংস্পর্শের মধ্যে কিংবা সংঘর্ষের মধ্যে প্রবেশ করলেই কাহিনির মুখে বাণী ফোটে এবং কাহিনি তখন অকপটে কথা বলতে শুর করে। একের পাশে অন্যের উপস্থিতি মাত্রই একটা জরুরি মুহূর্ত, এবং এই জরুরি সংস্পর্শ কিংবা সংঘাত থেকেই কাহিনিকল্প কিংবা নাট্য পরিস্থিতির জন্ম হতে শুরু করে। এই কথাটাও এখানে বলা যায়: ঘটনার সূতিকাগার আসলে মানুষ, প্রকৃতির বেগময়তার বাইরে মানুষের বেগই ঘটনার চলবিদ্যুৎ রূপে বইতে শুরু করে, এবং আবেগ এসে কিংবা চিন্তা এসে কিংবা কল্পনা এসে তাকে অন্যতর রূপময়তা দান করে। 
.
আইয়ুব মুহাম্মদ খানের এই রচনায় জমজমাট কাহিনি আছে, কাহিনির প্রবাহবেগ অজস্র রেখায় এগাতে এগোতে মানবতার একটা মানচিত্র তাতে ফুটে উঠতে দেখা যায়। নিজেও তিনি ওই মানচিত্রের মানুষ, তবে বোঝা যায়, অন্যতর শ্রেণিপরিচয়ের মানবতাই তাঁর প্রধান আলেখ্য। সমাজের চলতি বিন্যাসের মধ্যে যে-যেখানে অবস্থান করে তাদের দিয়ে নিজ নিজ ভূমিকাটি তিনি পালন করিয়ে নেন কলমের সহজ-স্বাভাবিক টানে, নানাজনের মুখে নানা সংলাপের আলাপন জুড়ে দিয়ে কাহিনিকে এগোতে সাহায্য করেন। কালের পটভূমিতে নানা ভাষার শেষ ধারার উপন্যাসরীতির প্রধান শৈলীস্বভাবের কথা এখানে অবশ্য না-তোলাই সঙ্গত মনে করছি। তবে আইয়ুব মুহাম্মদ খানের উপন্যাসে কাহিনির প্রবাহচিত্রে ছেদ ঘটিয়ে মাঝেমধ্যে ঘটনানিরপেক্ষ বিষয়গত আলোকপাতের প্রবণতাও লক্ষ করা যায়। 
.
অচলায়নে বাঁধা পড়া গ্রামজীবনের পরিচিত বৃত্ত ও বৃত্তান্তের আশ্রয়ে খ্যাতকীর্তি সাহিত্যিকেরা বহুকাল তাঁদের কলমের গতিবেগ সচল রেখেছেন; ওই ধারায় রচিত হয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কালাতিক্রমী উপন্যাসগুচ্ছ। ‘তিতাশ একটি নদীর নাম’, ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’র আঙ্গিকে গ্রামজীবনের যে চেনাচেহারা আমরা দেখেছি, হুবহু ওইরকম সাহিত্য প্রচেষ্টার বলা যেতে পারে এখন আর আবশ্যকতা নেই। ‘যে কখনো ভালোবাসে’ কাহিনিগ্রন্থে বদলে যাওয়া সময়ের প্রহারে গ্রামপল্লিকার যে অভাবনীয় রূপান্তর ঘটে গেছে, তার একটা জটিল আদলও উপস্থিত রয়েছে। একটা ’সার্থক’ বড়শিল্পের যে মশল্লাপাতি একজন লেখকের জন্য জরুরি হতে পারে, এখানে তার সমুদয় উপস্থিতি দেখতে পেয়ে লেখকের জন্য খানিক অনুশোচনাও মনের মধ্যে জমা না হয়ে পারলো না। কেননা, অকপটে এই বাক্যটিও আমার জন্য অবশ্য-উচ্চারণীয় যে, তাঁর লেখার গড়নে আমি অনেকখানি দুর্বলতা দেখতে পেয়েছি, যা এই রচনার অঙ্গকাঠামো ও প্রাকরণিক কৃৎকুশলতারই অঙ্গীভূত। 
.
তবে তাঁর বইয়ে চিত্তাকর্ষেণের দারুণ-কতকগুলো রঞ্জকতা আমি দেখতে পেয়েছি, যা আমাকে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে অনেকটাই সাহায্য করেছে। লেখকের প্রতি ক্রমপ্রসারমান শ্রদ্ধাশীলতার জন্য এবং একে সন্দেহাতীত মাত্রায় উত্তরিত দেখার আশায় সমালোচকরা কিছু মনে না-করলে আমি অনেকদিন অপেক্ষা করতে রাজি আছি।

জা,ই

সর্বশেষ

জনপ্রিয়